<p>বাংলার বারোভূঁইয়াদের অন্যতম ছিলেন ঈশা খাঁ। ন্যায়পরায়ণ শাসক ও বীরত্বের প্রতীক হয়ে তিনি ঠাঁই নিয়েছেন ইতিহাসের পাতায়। মুসলিম এ শাসকের রাজধানী ছিল নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁয়। ছিলেন সোনারগাঁ, গাজীপুরের কালীগঞ্জের বক্তারপুর, কিশোরগঞ্জের এগারসিন্ধুসহ ২২ পরগনার শাসক। মোগল শাসকদের সঙ্গে তাঁর একাধিক যুদ্ধ হয়েছিল। যুদ্ধের প্রস্তুতি ও প্রতিরোধের জন্য এগারসিন্ধু ও বক্তারপুরে দুর্গ স্থাপন করেছিলেন। জীবনের শেষদিকে সোনারগাঁয় ফেরার পথে অসুস্থ হয়ে পড়লে তিনি অবস্থান নেন বক্তারপুর দুর্গে। সেখানে একজন প্রখ্যাত হেকিমের চিকিৎসা গ্রহণকালে ৭০ বছর বয়সে ১৫৯৯ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর মৃত্যু হয় তাঁর।</p> <p>শেষ ইচ্ছা অনুযায়ী তাঁকে সমাহিত করা হয় বক্তারপুর দুর্গের দিঘির পশ্চিম পাড়ে। কালের পরিক্রমায় অযত্ন-অবহেলায় একসময় হারিয়ে যায় সমাধিচিহ্ন। তাঁর বীরত্ব, শাসন, মহানুভবতা, ন্যায়পরায়ণতা ও ধর্মপরায়ণতা নিয়ে নানা জল্পনা ও কল্পকাহিনি থাকলেও ইতিহাসের কোথাও তাঁর সমাধিস্থলের কথা উল্লেখ নেই। প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ দীর্ঘদিন অনুসন্ধান করে কয়েক বছর আগে বক্তারপুরের ধ্বংস হয়ে যাওয়া দুর্গে একটি প্রাচীন সমাধির সন্ধান পায়। নানা তথ্য-উপাত্ত ও ইতিহাস বিশ্লেষণ শেষে প্রত্নতত্ত বিভাগ নিশ্চিত হয় যে সমাধিটি ঈশা খাঁর। গত মঙ্গলবার গাজীপুরের জেলা প্রশাসক পরিদর্শনে গিয়ে সেই সমাধিস্থল সংরক্ষণের উদ্যোগের কথা জানান।</p> <p>ইতিহাস থেকে জানা যায়, ঈশা খাঁর বাবা সোলায়মান খাঁও ছিলেন জমিদার। বাবার পর ছেলে ঈশা দক্ষ সমরনায়ক ও দূরদর্শী জমিদার হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেন। সম্রাট আকবর সিংহাসনে বসে ভারতবর্ষের প্রায় সব এলাকায় শাসন কর্তৃত্বে আনতে পারলেও বাংলাকে পুরোপুরি কবজা করতে পারেননি। ওই সময় ১২ জন শাসক বাংলা প্রদেশে জোট গঠন করে নিজ নিজ এলাকা শাসন করতেন। তাঁদের নেতা ছিলেন ঈশা খাঁ। ইতিহাসে তাঁরা বারোভূঁইয়া নামে পরিচিত। সোনারগাঁ থেকে জঙ্গলবাড়ী, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সরাইল থেকে রংপুর ছিল বারোভূঁইয়াদের নেতা ঈশার শাসন এলাকা।</p> <p>মোগল সেনাপতি মানসিংহ ১৫৯৫ সালে কাপাসিয়ার টোকে ঈশা খাঁর সঙ্গে সম্মুখযুদ্ধে পরাজিত হন। পরবর্তী সময়ে আরো যুদ্ধ বাধার আশঙ্কায় বন্ধু ফজল গাজীর ভাওয়াল পরগনার বজ্রপুর (বর্তমান বক্তারপুর) গ্রামে একটি নৌদুর্গ গড়ে তুলেছিলেন ঈশা। ১৫৮৩ সাল পর্যন্ত বজ্রপুরে তাঁর অস্থায়ী বসতবাটি ছিল। ১৫৮৩ সালে শাহবাজ খাঁ বক্তারপুর আক্রমণ করে ঈশার নৌদুর্গ ধ্বংস করে দেন। পরবর্তী সময়ে এগারসিন্ধুতে ফেরার পথে ঈশা অসুস্থ হয়ে পড়েন। সোনারগাঁয় ফেরার পথে তিনি বজ্রপুর দুর্গে উঠে পূর্বপরিচিত হেকিমের চিকিৎসা নিতে থাকেন। প্রায় তিন মাস অসুস্থ থাকার পর  বক্তারপুরে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।</p> <p>তাঁর কবরটি দীর্ঘদিন ‘একজন বিশিষ্ট ব্যক্তি’র হিসেবে এলাকাবাসী জানত। ৩০-৩৫ বছর আগে প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ ওই গ্রামে গিয়ে কবরটি ঈশা খাঁর বলে চিহ্নিত করে। লোকজন বেড়া দিয়ে কবরটি সংরক্ষণের চেষ্টা করে। ২০০৪ সালে উপজেলা প্রশাসন দেয়াল তুলে কবরটি ঘিরে দেয়।</p> <p>স্থানীয় বাসিন্দা লুত্ফর রহমান জানান, দুর্গের অস্তিত্ব আর বক্তারপুর গ্রামে নেই। মাটি খুঁড়লে প্রাচীন ইট বের হয়। পুকুরটি প্রায় ভরাট হয়ে গেছে। ঈশা খাঁর সমাধি স্থানটি একটুি উঁচু ঢিবির মতো ছিল। পূর্বপুরুষরা বলে গেছে এটি পবিত্র স্থান।</p> <p>প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ স্থানটি খনন করে। প্রাচীন ইট ও কবর আকৃতির সমাধি আবিষ্কৃত হয়। পরে তারা জানায় যে, এটি ঈশা খাঁর কবর।</p> <p>ঢাকার ঈশা খাঁ ফাউন্ডেশনের মহাসচিব অ্যাডভোকেট মো. আবদুর রউফ জানান, প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ চিঠি দিয়ে বক্তারপুরে ঈশা খাঁর কবরের বিষয়টি নিশ্চিত করেছে। সরকারিভাবে এটি সংরক্ষণ এবং স্থানটিকে ঐতিহাসিক নিদর্শন হিসেবে গড়ে তোলার জন্য তিনি সরকারের বিভিন্ন দপ্তরে যোগাযোগ করে আসছেন।</p> <p>জেলা প্রশাসক ড. দেওয়ান মোহাম্মদ হুমায়ূন কবীর সমাধিটি ‘ঈশা খাঁ’র উল্লেখ করে বলেন, গাজীপুরের নামকরণ হয়েছে ফজল গাজীর নামানুসারে। ফজল গাজী ছিলেন বারোভূঁইয়াদের আরেক ভূঁইয়া। জমিদারি, শাসক ও বীরত্বে ঈশা খাঁর পরের স্থানই ছিল তাঁর। ঈশা খাঁ ও ফজল গাজী ছিলেন পরম বন্ধু। তাই ঈশা খাঁ ও গাজীদের পূর্বপুরুষের কবরসহ বহু নিদর্শন গাজীপুরে রয়েছে। প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ সমাধিটি আবিষ্কার করলেও প্রচারণার অভাবে দেশবাসী তেমন জানে না।</p>